বাংলাদেশের রিজার্ভ চুরিতে সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পাওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানসহ সাত কর্মকর্তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি। আদালতের অনুমতি নিয়ে ইতোমধ্যে নিষেধাজ্ঞার আদেশ ইমিগ্রেশনসহ যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। সিআইডি প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মো. মতিউর রহমান শেখ ‘ইকনোমি ডটকম’ এর প্রতিবেদককে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
নিষেধাজ্ঞা পাওয়া কর্মকর্তাদের মধ্যে সাবেক গভর্নর আতিউর রহমানের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না, তিনি দেশে নাকি বিদেশে সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে অন্য কর্মকর্তাদের বেশিরভাগ দেশেই আছেন বলে জানা গেছে।
নিষেধাজ্ঞা পাওয়া আরও ৫ কর্মকর্তার পরিচয় জানা গেছে। তারা হলেন- মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের সাবেক ম্যানেজিং ডিরেক্টর আনিস এ খান ওরফে আনিসউদ্দিন আহমদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা, মেইন্টেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী পরিচালক দিপঙ্কর কুমার চৌধুরী, সাবেক অতিরিক্ত পরিচালক এসএম রেজাউল করিম এবং অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং ডিপার্টমেন্টের (এবিডি) ডিলিং রুমের সহকারী পরিচালক শেখ রিয়াজ উদ্দিন।
গত ১৭ জানুয়ারি ৭ কর্মকর্তার দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞার খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এরপর গুঞ্জন ওঠে এসব ব্যাক্তিরা দেশে আছেন নাকি দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। এ বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, সাত কর্মকর্তার মধ্যে অন্তত ৪ জন দেশেই আছেন। বাকী ৩ জনের সন্ধান পাওয়া যায়নি। সাবেক গভর্নর আতিউর রহমানের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য মেলেনি। কোন কোন সূত্রে খবর মিলছে, নিষেধাজ্ঞার আগেই তিনি দেশ ছেড়েছেন। আবার তার ঘনিষ্ট সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে তিনি দেশেই আছেন। এ প্রতিবেদকের পক্ষ থেকে তার ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরে ফোন করে বন্ধ পাওয়া গেছে। অনলাইনে যোগাযোগের চেষ্টা করে দেখা যায় তিনি ইন্টারনেট সংযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন রয়েছেন।
গতকাল ১৮ জানুয়ারি শনিবার অন্য চার কর্মকর্তার সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়েছে। এরমধ্যে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিস এ খান ঢাকায় অবস্থান করছেন। তিনি বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে আমি কিছু জানি না। আমি ঢাকায় আছি।’
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা বলেন, ‘কোন সংস্থার পক্ষ থেকে আমার কাছে কিছু জানতে চাওয়া হয়নি। আমাকে দেশ ছাড়তে নিষেধ করা হয়েছে এমন কোন খবরও আমি জানি না।’ তিনি দেশেই আছেন তবে কোথায় আছেন জানতে চাইলে ফোন কেটে দেন।
দিপঙ্কর কুমার চৌধুরীও দেশেই আছেন। তার ব্যবহৃত মোবাইল নম্বরে কল করা হলে তিনি এ প্রতিবেদকের পরিচয় জানার পর কল কেটে দেন। এরপর অনেকবার কল করা হলেও তিনি ধরেননি। সাবেক উপমহাব্যবস্থাপক (এই পদের বর্তমান নাম অতিরিক্ত পরিচালক) এসএম রেজাউল করিম বলেন, ‘আমি দেশেই আছি। নিষেধাজ্ঞার কথা আমি জানি না। রিজার্ভ ইস্যুতে যেসব বিষয় ছিল তা সমাধান হয়েছে। এখন নতুন করে কেন বিষয়গুলো সামনে আনা হচ্ছে বুঝতে পারছি না।’ নিষেধাজ্ঞা পাওয়া অপর কর্মকর্তা শেখ রিয়াজ উদ্দিনের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা সম্ভব হয়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, দীর্ঘ সময় ধরে আলোচিত মামলাটির তদন্ত ধীরগতিতে চলছিল। এমন প্রেক্ষাপটে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুল্লা আল ইয়াছিনকে এ মামলার দ্বিতীয় তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ করা হয়। তার তদন্তে মোট ১৪ জনের সংশ্লিষ্টতা উঠে আসে। তাদের মধ্যে সাতজনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক (যিনি রিজার্ভ হ্যাকের আলামত নষ্টের দায়ে অভিযুক্ত), সাবেক একজন ডেপুটি গভর্নরসহ আরও সাত কর্মকর্তাকে নজরদারিতে রেখেছেন গোয়েন্দারা।
সিআইডির তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রিজার্ভ সরানোর ঘটনা জেনেও পুরোপুরি গোপন রেখেছিলেন তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমান। অভিযোগ রয়েছে- তিনিসহ সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তাদের বাঁচাতে মামলা করার সময় চুরির ধারা ৩৭৯ বসানো হয়। উদ্দেশ্য, মামলাটি যেন অন্য কোনো সংস্থায় না পাঠিয়ে সিআইডিকে দিয়েই তদন্ত শেষ করা যায়। তখন সরকারের দায়িত্বশীলরা চেয়েছিলেন একটি ফরমায়েশি প্রতিবেদনের মাধ্যমে ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে।
সিআইডিকে রিজার্ভ চুরির মামলা তদন্তের দায়িত্ব দেওয়ার পর তৎকালীন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বর্তমানে অতিরিক্ত ডিআইজি) রায়হান উদ্দিন খানকে তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ করা হয়। তদন্তে নেমে ওই কর্মকর্তা জানতে পারেন- এই অপকর্মে বিদেশি নাগরিকদের সহযোগিতা করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কতিপয় কর্মকর্তা। এ মামলার তদন্তের অংশ হিসেবে ফিলিপাইন, চীনসহ কয়েকটি দেশেও গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সে সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের নাম উঠে আসায় তদন্ত নতুন মোড় নেয়।
আওয়ামী লীগ সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের জড়িত কর্মকর্তাদের নাম বাদ দিয়ে মামলার চার্জশিট দিতে চাপ প্রয়োগ করা হয়। তাতে রাজি না হওয়ায় ওই কর্মকর্তাকে তদন্তের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেন সিআইডির তৎকালীন প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যাংক থেকে বাংলাদেশের রক্ষিত ডলার সরিয়ে নেওয়ার অপরাধের পেছনে একটি দীর্ঘ পরিকল্পনা ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরাপত্তার সিস্টেমে ২০০৯ সালে যে কাজ করা হয়েছে, সেখানে ফিলিপাইনের সাইবার টিম ছিল। মূলত তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরাপত্তা সিস্টেমের গোপনীয়তা সম্পর্কে ফিলিপাইনের টিমগুলো জেনে যায়। ২০১৫ সালের দিকে পরিপূর্ণ পরিকল্পনা করে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে তা বাস্তবায়ন করা হয়।
প্রসঙ্গত, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় চুরির ওই ঘটনা দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে সুইফট ব্যবস্থা কাজে লাগিয়ে ৩৫টি ভুয়া বার্তার মাধ্যমে ফেডারেল রিজার্ভের নিউইয়র্ক শাখায় বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব থেকে ১০০ কোটি ডলার চুরির চেষ্টা চালায় অপরাধীরা। এর মধ্যে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার লোপাট করতে সক্ষম হয় তারা। এই অর্থের মধ্যে শ্রীলঙ্কায় যায় দুই কোটি ডলার। সেই অর্থ অবশ্য উদ্ধার করা হয়েছে। তবে বাকি ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার আরসিবিসি ব্যাংক হয়ে ফিলিপাইনের বিভিন্ন ক্যাসিনোয় ঢুকে যায়। চুরি যাওয়া অর্থের মধ্যে এ পর্যন্ত সব মিলিয়ে ৩ কোটি ৪৬ লাখ ডলার উদ্ধার করা হয়েছে। বাকি ৬ কোটি ৬৪ লাখ ডলার এখনও পাওয়া যায়নি।
রিজার্ভ চুরির ঘটনাটি শুরুতে গোপন রাখে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। ঘটনার ৪১ দিন পর কর্তৃপক্ষ তাদের সুইফট সিস্টেম হ্যাক করে রিভার্স চুরি করা হয়েছে বলে একটি মামলা করে। ৫৪ ধারায় করা মামলাটিতে চুরির ৩৭৯ ধারাও জুড়ে দেওয়া হয়। এ মামলা তদন্তের দায়িত্ব পায় সিআইডি। আলোচিত এ ঘটনার পর গণমাধ্যমগুলো ফলাও করে নানা সময়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করলেও মূল ঘটনা ও ঘটনার সঙ্গে জড়িতরা আড়ালেই থেকে যায়।
জানা গেছে, তদন্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের ১৪ কর্মকর্তার নাম আসার পর সরকার পতনের কয়েক দিন আগে তাদের নাম বাদ দিয়ে চার্জশিট দিতে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বর্তমানে পুলিশ সুপার) আবদুল্লাহ আল ইয়াছিনকে চাপ দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা শাখার (বিএফআইউ) তৎকালীন প্রধান মাসুদ বিশ্বাস। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তা আর সম্ভব হয়নি। গতকাল অন্য একটি মামলায় মাসুদ বিশ্বাসকে গ্রেপ্তার করেছে দুদক।